রাত এগারটা। সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী দূরপাল্লার বাসটা।আড়াই ঘন্টা আগে বাসটা কক্সবাজার থেকে ছেড়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করবে।
গোটা বাসে জনা বিশেক যাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। সপ্তাহের মধ্যখান হওয়ায় এই যাত্রী সংকট। তবে চট্টগ্রাম থেকেও হয়ত কিছু যাত্রী উঠবে।
বিশ মিনিট পর বাসটা ঝাকি খেয়ে থেমে গেল চট্টগ্রাম শাখার কাউন্টারে। দশ মিনিট বিরতি, চা খাবার জন্য নেমে এলাম বাস থেকে। মিনিট পাঁচেক পর বাসে উঠলাম এবং সাথে সাথে চমকেও উঠলাম আমার সীটের দিকে তাকিয়ে।
আমার সীট নাম্বার D-1। আমার পাশের সীট অর্থাৎ D-2 -একটা পরী বসে আছে, তবে ডানাটা বোধহয় ভুলে বাসায় ফেলে এসেছে। পুরো বাসটাই যেন মেয়েটার রুপে আলোকিত হয়ে আছে। বাস কক্সবাজার থেকে ছাড়ার সময় মেয়েটা ছিলনা, চট্টগ্রাম থেকে উঠেছে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠলাম পুরো পথটা এমন অসম্ভব রুপসী একটা মেয়ের সাথে কাটাতে পারব ভেবে।
“এক্সকিউজ মি, ওই সীটটা আমার, “কাছে গিয়ে ^বললাম।
পরীটা উঠে দাড়িয়ে আমাকে জায়গা করে দিল। আমি বসামাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল।
“আমি অভি, “কিছুক্ষণ পর ইতস্তত করতে করতে বললাম। “বাসটা অনেক জোড়ে চলছে, তাইনা? “আর কিছু বলার মত না পেয়ে শেষের উদ্ভট কথাটা বললাম।
“আমি মাহী, “স্মিত হেসে জানাল মেয়েটা।
“কোথায় যাচ্ছেন?”বললাম আমি।
মাহী আমার প্রশ্নটা শুনে এবার আর মুচকি নয়, বেশ জোরের সাথেই হেসে উঠল।
“ঢাকাগামী বাসে ঢাকা ছাড়া আর কোথায় যাব? ” একটু বিরতি দিয়ে ফের বলল, “আপনি বোধহয় মেয়েদের সাথে কথা বলে অভ্যস্ত নন। ”
লজ্জা পেলেও সত্যি কথাটার প্রতিবাদ করতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
আমার মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে মাহী বলল, ঠিকআছে আপনাকে আর বোকার মত প্রশ্ন করতে হবেনা আমিই করছি, “ঢাকায় কি বেড়াতে যাচ্ছেন নাকি বেড়ানোর ইতি টানতে? ”
প্রথমে মেয়েটার সাহিত্য মার্কা প্রশ্ন বুঝতে পারলামনা, একটু পর বুঝে বললাম, “ইতি টানতে। কক্সবাজার গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে। আপনি? ”
“আমি একটা কাজে যাচ্ছি ঢাকায়।কী করছেন আপনি? “জবাবের শেষে প্রশ্ন জুড়ে দিল মাহী।
“আমি পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যাবসা দেখছি আর সময় পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ছি। ”
“তাইনাকি, এখানে দেখা যাচ্ছে আমাদের একটা মিল আছে, আমিও খুব ভ্রমণ পিপাসু। ”
“সেটা আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি, নইলে এত রাতে একা একটা মেয়ের জার্নি করা তেমন চোখে পড়েনা। আচ্ছা, আপনার ভয় করেনা? ”
“ভয় কেন করবে? “পাল্টা প্রশ্ন করল মাহী, “রাতটা তো বাসেই কাটবে। আর সকাল হলেই পৌছে যাব ঢাকায়। ”
খানিক চুপ থাকার পর মেয়েটা সময় জানতে চাইল। আমি আমার দামি মোবাইলটা ওকে দেখাবার সুযোগ. পেয়ে ভারী খুশি হলাম। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি সোয়া বারটা বাজে। আমি মেয়েটার মত সাহিত্য করে বললাম, “এগারটা বেজে পচাত্তর মিনিট।”
শুনে মাহী প্রায় অট্টহাসির কাছাকাছি একটা হাসি দিয়ে ফেলল। আমার জবাবে অতিমাত্রায় সাহিত্য ঢুকে যাওয়াতেই হাসিটা দিল কিনা ঠিক বুঝতে পারলামনা। তবে হাসিটাতে কিন্তু প্রশংসা খুঁজে পেলামনা, বরং ব্যঙ্গের সুরটাই যেন কানে বাজল বেশি করে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। চুপ করে রইলাম। একটু পর আমার মন ভাল করতেই কিনা ব্যাগ থেকে একটা পাটিসাপটা পিঠা বের করে বাড়িয়ে দিল মাহী আমার দিকে।
পিঠাটা যদি আমার মন ভাল করার জন্যই. দিয়ে থাকে তাহলে আমার মত অনেকেই. বলতে বাধ্য হবেন মোক্ষম অস্ত্রই বেছে নিয়েছে মাহী। খাবার. টাবার দেখলে আমার মন আবার কখনোই খারাপ থাকেনা। কেউ সাধলে আমার দৃষ্টিতে মানা করাটাও অভদ্রতা। পিঠাটা কখন যে গলধঃকরণ হতে লাগল জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবনা। আরও তিনটা পিঠা ধ্বংস করে মন ভাল করে ফেললাম।
এরপর আবার কথা শুরু হয়ে গেল আমাদের মাঝে। উপলব্ধি করলাম, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মত আমার দাঁত ফোটাবার মত অযোগ্যবিষয়গুলোও কি করে সরস হয়ে উঠতে পারে।শুধু পাশে এমন একটা মেয়ের অস্তিত্ব থাকতে হবে, যে তার ডানা বাসায়. রেখে এসেছে।
গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবনা। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে পাশে মাহীকে দেখতে না পেয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা সাইনবোর্ডে “কুমিল্লা” লেখা দেখতে পেলাম। ঢাকা এখনও দুঘন্টারও বেশি পথ। এত আগে মেয়েটা কোথায় নেমে গেল? কোন বিপদ হয়নি তো? আমার ঘুমন্ত অবস্থায় আরেকটা বিরতিতে নেমে হয়ত উঠতে পারেনি। মাহীর অনিষ্ট আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠল।
বাসের সুপারভাইজারের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা আমার পাশের সীটে যে মেয়েটা বসে ছিল সে কোথায় বলতে পারেন?”
“উনি তো আধঘণ্টা আগে কুমিল্লায় নেমে গেলেন। ”
“নিজের ইচ্ছায় নেমেছে? ”
“না, উনাকে জোর করে নামানো হয়েছে। “বিরক্ত হয়ে বলল সুপারভাইজার।
বাসের সুপারভাইজাররা সাধারণত. ভদ্র ব্যাবহার. করে থাকে, তবে আমার প্রশ্নটা বোধহয় বোকার মত হয়ে গিয়েছিল। সুপারভাইজার আরো অভদ্র হবার আগেই সীটে ফিরে এলাম।
মনটা প্রচন্ড রকমের খারাপ। মনে হল কি যেন হারিয়ে ফেলেছি। বুকটা খালি খালি লাগছে। এত স্বল্প পরিচয়ে কোনো মেয়ে আমার মনে এতটা দাগ কাটতে পারেনি। ওকে কোনদিনও ভুলতে পারবনা আমি।
কিভাবে ভুলব বলুন? এত রুপসী একটা মেয়ে যদি আপনাকে যত্ন করে পিঠা খাইয়ে,ঘুম পাড়িয়ে আপনার বুক পকেটে রাখা দামি মোবাইলটা নিয়ে চুপিচুপি নেমে পড়ত, আপনি ভুলতে পারতেন? বুকটা একটুও কি খালি খালি লাগতনা?মেয়েটার জন্য নয় মোবাইলের জন্য।